সভাপতির বাণী

‘পার্বত্য বৌদ্ধ সংঘ’ একটি অরাজনৈতিক ও অলাভজনক সংগঠন। এ সংগঠনটি বাংলাদেশের তিন পার্বত্য জেলার সর্বক্ষেত্রে অনগ্রসর আদিবাসী বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর মাঙ্গলিক আশা-আকাক্সক্ষাকে বুকে ধারণ করে ১৯৭৬ সালের এক শুভলগ্নে প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজধানী ঢাকাসহ বাংলাদেশের ৬৪টি জেলায় জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে সরকারি, আধাসরকারি, বেসরকারি ও এনজিও-সহ নানা সেক্টরে কর্মরত আদিবাসী বৌদ্ধদের আজন্ম লালিত সংস্কৃতি ও বৌদ্ধ ধর্মীয় বিধি বিধান মেনে চলার তীর্থ ক্ষেত্র বিনির্মাণ ও সর্বোপরি আদিবাসী বৌদ্ধদের মিলন তীর্থ হিসেবে গড়ে তোলার প্রত্যাশায় ‘পার্বত্য বৌদ্ধ সংঘ’ কর্তৃক রাজধানী ঢাকার মিরপুরে শাক্যমুনি বৌদ্ধ বিহার প্রতিষ্ঠিত হয়। এ বিহার প্রতিষ্ঠায় পর পর দুইজন মহান সাবেক রাষ্ট্রনায়ক যথাক্রমে মহামান্য রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বীরউত্তম ও মহামান্য রাষ্ট্রপতি হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদ প্রচলিত ভূমি লিজ নীতিমালা অনুযায়ী সেলামী পরিশোধ সাপেক্ষে পার্বত্য বৌদ্ধ সংঘকে দু’দফায় দু’খন্ড জমি প্রদান করে পার্বত্য আদিবাসী বৌদ্ধদের স্বপ্ন পূরণে সহায়তা করেন। এ বিহার প্রতিষ্ঠার প্রারম্ভিক পর্বে যাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রম, অবদান, ত্যাগ-তিতিক্ষা ও দূরদর্শিতা বিশেষ উল্লেখযোগ্য ও স্মরণযোগ্য, তাঁরা হলেনÑ সর্বজন শ্রদ্ধেয় ভদন্ত বিমল তিষ্য মহাথেরো, প্রয়াত রাজমাতা মহীয়সী রাণী বিনীতা রায়, মাননীয় জাতীয় সংসদ সদস্য উপেন্দ্র লাল চাক্মা (এমপি), বাবু শরদিন্দু শেখর চাক্মা, ড. নিরু কুমার চাকমা, ড. প্রদানেন্দু বিকাশ চাকমা, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব:) মংখিউ মং মারমা ও প্রকৌশলী কৃষ্ণ মোহন চাকমা প্রমুখ। এ ছাড়াও পার্বত্য বৌদ্ধ সংঘের অগণিত হিতাকাঙ্ক্ষী, ভক্তবৃন্দ, গুণগ্রাহী ব্যক্তিবর্গের মেধা ও মননের অন্তরঙ্গ সম্পৃক্ততা এ প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বর্তমান সময়কাল পর্যন্ত ফলগুধারার মতো সতত প্রবহমান রয়েছে বলেই প্রতিষ্ঠানটির পর্যায়ক্রমিক অগ্রগতি সাধিত হচ্ছে।

 

আনুপূর্বিক ধারাবাহিকতায় শাক্যমুনি বৌদ্ধ বিহারকে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠিত হয়- ‘বনফুল কমপ্লেক্স।’ এ বনফুল কমপ্লেক্সেই ১৯৯০ খ্রি: প্রতিষ্ঠিত হয় ‘বনফুল শিশু সদন ও বনফুল প্রাইমারি স্কুল’। বর্তমান বনফুল আদিবাসী গ্রীনহার্ট কলেজ, বনফুল শিশু সদন ও বনফুল প্রাইমারি স্কুলেরই বর্ধিত ও পরিণতরূপ। পার্বত্য বৌদ্ধ সংঘের উপদেষ্টামন্ডলীসহ কার্য নির্বাহী পরিষদ ও সাধারণ সদস্য-সদস্যাদের পরামর্শক্রমে এ সংঘেরই ৭ (সাত) জন বিদ্যোৎসাহী সদস্য-সদস্যা ‘বনফুল আদিবাসী ফাউন্ডেশন ট্রাস্ট’ গঠন করেন। বস্তুত এ ট্রাস্টের দ্বারাই ২০০৪ খ্রিস্টাব্দের ৯ জুলাই ‘বনফুল আদিবাসী গ্রীনহার্ট কলেজ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এ বনফুল আদিবাসী গ্রীনহার্ট কলেজ প্রতিষ্ঠার পেছনে যাঁদের অকুণ্ঠ সমর্থন, প্রাণময় সহায়তা ও সহযোগিতা পেয়েছি- তাঁদের নাম এখানে কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করছি। তাঁরা হলেন- গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের মাননীয় চেয়ারম্যান সর্বজন শ্রদ্ধেয় শ্রী জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (ওরফে সন্তু লারমা), পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাননীয় সাবেক উপ-মন্ত্রী বাবু মণি স্বপন দেওয়ান ও পার্বত্য বৌদ্ধ সংঘের কেন্দ্রীয় কার্য নির্বাহী পরিষদের দূরদর্শী সদস্য ও সদস্যাবৃন্দ।

 

বনফুল আদিবাসী ফাউন্ডেশন ট্রাস্ট বড়ই সৌভাগ্যবান যে, এ বনফুল আদিবাসী গ্রীনহার্ট কলেজটি সুষ্ঠু , সুন্দর ও সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনা এবং আমাদের ভাবী প্রজন্মকে এদেশের এক একজন প্রতিশ্রুতিশীল সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে সুদৃঢ় ভিত্তিদানের লক্ষ্যে প্রগাঢ় ভালোবাসা ও দায়বদ্ধ দায়িত্বের অনুষঙ্গ ও অটল বিশ্বাসে আত্মনিবেদিত অধ্যক্ষ, একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনা ও বাস্তবায়ন কমিটির  আহ্বায়ক ও সদস্যবৃন্দ এবং ৯২ জন দক্ষ, অভিজ্ঞ, প্রশিক্ষিত, বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতম ডিগ্রিধারী নবীন ও প্রবীণ সুশিক্ষক পেয়েছি- যাঁদের অভিজ্ঞতা, সুনাম, সুযশ ও সুকীর্তি স্বকীয় গৌরবের শীর্ষ চূড়ায় স্বমহিমায় দেদীপ্যমান। আমাদের ভাবী প্রজন্মের প্রতি তাঁদের নিখাদ ভালোবাসা, অবিচল আস্থা, দায়বদ্ধ দায়িত্ব প্রতিপালনের সুদৃঢ় প্রত্যয় ও নিরন্তর অক্লান্ত পরিশ্রমের বিনিময়ে এ কলেজের সুনাম, সুযশ ও সুকীর্তি বৃদ্ধিতে প্রাণময় এষণার পরিচয় ইতোমধ্যেই তাঁরা দিতে শুরু করেছেন। ২০০৬Ñ২০২০ খ্রি:-এ পনের বছরের ব্যাপ্তিকালে উচ্চ মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক বোর্ড পরীক্ষায় এ কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের ফলাফলের পৌনঃপুনিক উন্নতি তার বড় প্রমাণ। ২০০৮ খ্রি: এর মাধ্যমিক বোর্ড পরীক্ষায় প্রথম বারের মতো ১১ (এগার) জন পরীক্ষার্থী  G.P.A-5 পেয়ে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছে। সাফল্যের এ ধারা এখনো অব্যাহত আছে। ২০২২-২০২৩ শিক্ষাবর্ষের সকল পাবলিক পরীক্ষার সাফল্যের খতিয়ানের নিরিখে এ ধারা আরো বেগবান ও বর্ধিষ্ণু হয়ে শতভাগ পাশ ও উল্লেখযোগ্য G.P.A.–5 অর্জন নিশ্চিত করার গৌরব অর্জন করেছে।

 

মিরপুরের বিশাল জনগোষ্ঠীর প্রয়োজনের তুলনায় ভাল মানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাব অনেক দিনের। এ এলাকায় বসবাসরত সুধী নাগরিকবৃন্দ ও দূরদর্শী জনগোষ্ঠী এত দিন যাবৎ আরও ভালমানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করে আসছেন। তিন পার্বত্য জেলার আদিবাসী জনগোষ্ঠীর দেশপ্রেমিক, শিক্ষানুরাগী, বিচক্ষণ ও দূরদর্শী অভিভাবকরা সমতলের কোমলমতি বালক-বালিকা ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বালক বালিকাদের মিলিত অনুষঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষ ও মৈত্রীপূর্ণ আবহে পাঠদানের উপযোগী একটি সর্বাঙ্গ সুন্দর বিদ্যায়তন প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ও সম্ভাবনা বহু যুগ আগ থেকে লালন করে আসছেন। তাদের বহু যুগ ধরে লালিত স্বপ্ন ও সম্ভাবনার অতীব ক্ষুদ্র প্রয়াস হ’ল- আজকের এ ‘বনফুল আদিবাসী গ্রীনহার্ট কলেজ’। চিরায়ত মানবিক আবহে একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার উপযোগী প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ছাত্র-ছাত্রীদের সুদৃঢ় ভিত্তি বিনির্মাণ করে দেয়াই এ কলেজের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।

 

এ প্রতিষ্ঠানটিকে সকল প্রকার দলীয় রাজনৈতিক কর্মকান্ড থেকে দূরে রাখা হয়। শতভাগ দূষণমুক্ত পরিবেশ বজায় রেখে ছাত্র-ছাত্রীদেরকে পাঠদানে সযত্ন ও নিয়মনিষ্ঠ মনিটরিং এর ব্যবস্থা রয়েছে। সম্মানিত অভিভাবক ও অভিভাবিকামন্ডলীর ন্যায়সঙ্গত দাবির প্রতি সম্মান প্রদর্শনপূর্বক বিজ্ঞান ও ব্যবসায় শিক্ষা শাখার পাশাপাশি একাদশ শ্রেণিতে মানবিক শাখা চালু করা হয়েছে। সরকারি পাঠ্যসূচি অনুসরণে বাংলা ও ইংরেজি ভার্সনে প্লে-নার্সারি হতে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত প্রভাতি ও দিবা শাখায় ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করা হচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে এ কলেজটিকে কেন্দ্র করে বনফুল আদিবাসী গ্রীনহার্ট বিশ্ববিদ্যালয় চালু করার মহতী পরিকল্পনা বনফুল আদিবাসী ফাউন্ডেশন ট্রাস্ট কর্তৃপক্ষ দৃঢ়ভাবে পোষণ করেন।

 

উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যহীন কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মানব কল্যাণে ও মানব সম্পদ উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে না। আধুনিক জ্ঞান চর্চার মধ্য-দিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের মেধার যথাযথ বিকাশ এবং প্রকৃত মানুষরূপে গড়ে তোলার মহাপরিকল্পনায় আদর্শ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা ও ভূমিকা অপরিসীম। মানব শিশুর সুপ্ত মেধা ও মননের বিকাশ ঘটিয়ে তাকে পরিপূর্ণ মানবিক গুণাবলীতে ঋদ্ধ করে দেশপ্রেমিক মানুষ রূপে গড়ে তোলাই শিক্ষার মুখ্য উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। এটি অবিসংবাদিত সত্য যে, শিক্ষা মানুষকে শিষ্টাচারী, আত্মবিশ্বাসী ও বিনয়ী করে গড়ে তোলে। এ রূপ শিষ্টাচারী, আত্মবিশ্বাসী ও অসা¤প্রদায়িক মানুষ তৈরি করাই হ’ল এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মুখ্য উদ্দেশ্য। এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণির মানুষের মঙ্গল সাধন করবে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। এ লক্ষ্য অর্জনে রাজধানী ঢাকা ও মিরপুর এলাকাবাসীর সক্রিয় সাহায্য ও সহযোগিতা ঐকান্তিক শ্রদ্ধাবনতচিত্তে কামনা করি। এই মহতী লক্ষ্য অর্জনে মানবপুত্র বুদ্ধের কর্মযোগ আমাদের সকলের সহায় হোক।

 

 

 

 

ভেন. প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো

সভাপতি, গভর্নিং বডি